অনলাইন ডেস্ক : জাল প্রশিক্ষণ সনদ দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ঘটনায় অতীতে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো (বিএমইটি)। কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, বিএমইটি ও এর অধীন বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এ অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে! প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারির ফলে প্রশিক্ষণের জাল সনদে বিদেশ পাঠানোর অনিয়ম বলা চলে বন্ধ। কিন্তু এবার বিনা প্রশিক্ষণ সনদে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ঘটনা তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত স্বয়ং বিএমইটির একজন পরিচালক। বর্তমানে সংস্থাটির প্রশাসন শাখায় কর্মরত এই কর্মকর্তা যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহির্গমন শাখায় কর্মরত ছিলেন, তখন তার হাত দিয়েই বিনা প্রশিক্ষণ সনদে বিদেশ পাঠানোর ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, কোনো শ্রমিক বিদেশ যেতে হলে বিএমইটি অধিনস্থ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এরপর তাকে সনদ দেন সংশ্লিষ্টরা। সেটি বিএমইটির বহির্গমন শাখায় সাবমিট করে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি। মহিলা কর্মীদের ক্ষেত্রে ১ মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষণ সনদ ছাড়া বিদেশ পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেশ কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণ সনদ ছাড়াই ওমানসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন বিএমইটির ইমিগ্রেশন শাখার পরিচালক (উপসিচব) ছিলেন মো. রেজাউল করিম।
এ ধরনের ফাইল বা ডকুমেন্টস এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ফাইল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরো বেঙ্গল এভিয়েশন লি. (আরএল-১৬৮১) এর ওমানগামী ১৮ জন পুরুষ কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য আবেদন করে। এ ১৮ জন কর্মীরই প্রশিক্ষণ সনদ নেই। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সেকশন অফিসার হয়ে এই নথি পরিচালক বরাবর উপস্থাপন করা হয়। কোভিড ১৯ ও ভিসার মেয়াদ স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে প্রশিক্ষণ সনদ ব্যতীতই ওই ১৮ জন কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র দেন রেজাউল করিম। এরপর সেটা আর উপরে না তুলে এটি সরাসরি অনুমোদন দেন। যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত। মেসার্স এইচপি ওভারসীজ (আরএল ১৩৮৮) নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি ওমানগামী ৮ জন পুরুষ কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে। এই ৮ জনের মধ্যে ২ জনের প্রশিক্ষণ সনদ ছিল না। কিন্তু পরিচালক রেজাউল করিম গত ১৭ ডিসেম্বর প্রশিক্ষণ না নেওয়া এই ২ জনসহ সবাইকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ ছাড়পত্র প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণ সনদ ছাড়াই একই এজেন্সির আরও ৬ জন কর্মীকে গত ২১ ডিসেম্বর ‘বিশেষ বিবেচনায়’ বহির্গমন অনুমোদন দেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিএমইটির মহাপরিচালকের নির্দেশনা ছাড়া এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত কোনো পরিচালক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা নিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে রেজাউল করিম কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে সুবিধা নিয়ে এসব অনুমোদন দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু এই কয়েকটি এজেন্সি নয়,২০২০ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৭ মে পর্যন্ত বহির্গমন পরিচালক থাকাবস্থায় এভাবে বিনা প্রশিক্ষণে বিনা সনদে বিভিন্ন দেশে কর্মী যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এসব করেছেন রেজাউল করিম ও তার বিশ্বস্ত একাধিক কর্মকতা। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, উপসচিব মো. রেজাউল করিম ২০১৯ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এর আগে তিনি রাজউকসহ বেশ কিছু লোভনীয় জায়গায় চাকরি করেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গতবছরের আগস্টে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহির্গমন শাখার পরিচালক হন। কোনো কর্মী বা শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হলে এই বহির্গমন শাখা থেকেই ছাড়পত্র নিতে হয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই কর্মকর্তার সঙ্গে রিক্রুটিং এজন্সিগুলোর সখ্য গড়ে ওঠে। সকল নথি স্বাক্ষর করা বাবদ উৎকোচ হিসেবে হাজার হাজার টাকা গ্রহণ করার অভিযোগ ওঠে রেজাউলের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, সৌদি আরবের নাজরানা প্রদেশে কাজের জন্য ভিসায় বহির্গমন বন্ধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও ওই প্রদেশের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর আবেদন করা বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একইভাবে উৎকোচ বাণিজ্যেও মাধ্যমে তিনি ইউরোপীয় দেশের বহির্গমন বাবদ মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করেন। কিছু রিক্রুটিং এজন্সীর সঙ্গে আঁতাত করে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
জানা যায়, বিষয়টি তৎকালীন মহাপরিচালক মো. শামসুল আলমের নজরে আসলে উপসচিব মো. রেজাউল করিমকে বহির্গমন থেকে প্রশাসন শাখায় বদলি করেন। এটি রেজাউল করিম ভালোভাবে নেননি। তিনি মহাপরিচালকের বিরুদ্ধেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন এবং বিএমইটির কয়েকজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামেন।
এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম গতকাল বুধবার দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, বিদেশে শ্রমিকরা প্রশিক্ষণের ছাড়পত্র ছাড়া যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মীর জালিয়াতির মাধ্যমে বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা নজরে আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি রিক্রুটিং এজেন্সির সনদ বাতিলের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) শামসুল আলম গতকাল বুধবার দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে শ্রমিকরা যথাযথ অনুমোদনসহ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বাইরে গেছে। কোনো জালিয়ার মাধ্যমে সনদ দেওয়া হয়নি। এখন জালিয়াতি করে সনদ দেওয়া হচ্ছে কি? জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি আরব আমিরাতে সনদ ছাড়াই শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। তার অনুমোদন ছিল কি না জানা নেই। তবে সম্ভবত এখন প্রশিক্ষণ ছাড়া কর্মী পাঠানো যায় না।
এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রধান শরীফুল হাসান গতকাল দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, বিদেশে শ্রমিক যাওয়ায় আগে অবশ্যই প্রশিক্ষণ কিংবা ওরিয়েন্টেশনে আসতে হবে। তা না হলে বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পাবে না। এ কারণে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে যেতে হয়। যারা জালিয়াতি করে সনদ নিয়ে যায়, তারা হয়তো নদীপথে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে মো. রেজাউল করিমের মোবাইলে বারবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলার বিবেক /এম এস
Leave a Reply