অনলাইন ডেস্ক : ১৮ মার্চ, ১৯৭১। চারদিকে বাঙালির গগনবিদারী রণধ্বনি। একাত্তরের এদিন পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৯০ মিনিটের বৈঠক শেষ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বৈঠক যে নিষ্ফল তা বের হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধুর অবয়বে ধরা পড়ে। বাইরে তখন জনতার ভিড়। উৎসুক চোখে তারা তাকিয়ে আছে প্রিয় নেতার মুখের দিকে।
বৈঠককে ঘিরে ভিড়ের মধ্যে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের অগ্রগতি সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়। পুরো বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তখন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছোট এ ভূখণ্ডের চলমান ঘটনাবলির দিকে। তৃতীয় দিনের মতো পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসামাত্রই চারদিক থেকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। কালো পতাকাশোভিত সাদা গাড়ি থেকে নামেন বঙ্গবন্ধু। উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, দাবি না মেটা পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদে বসতে পারি না। সাধারণ মানুষের ওপর সেনাবাহিনীর শুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, টঙ্গী-জয়দেবপুরসহ বহু স্থানে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে চলছে। তাহলে এ আলোচনার অর্থ কী? শহিদদের রক্তের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা আবার কথা বলব পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। তবে কোনো আপস নয়।’ অগ্নিঝরা একাত্তরে এ দিনে জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণের পর কারফিউ জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, তারা (পাকিস্তানি শাসক) যদি মনে করে থাকে যে, বুলেট দিয়ে জনগণের সংগ্রাম বন্ধ করতে সক্ষম হবে, তাহলে তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে। কিন্তু ওই বৈঠক সম্পর্কে শহরে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিশেষ মহল গুজব ছড়িয়ে দেয়, শেখ মুজিব ক্ষমতার লোভে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপসরফা করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে যাচ্ছেন। তারা দেশব্যাপী প্রচারণা চালায়, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় ইসলাম ও কোরআনি মুসলমানরা জীবন বাজি রেখে শেখ মুজিবুরের এই হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।
যদিও দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এ দিনেই প্রথম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে জয়দেবপুরের মানুষ। গর্জে ওঠে প্রথম বাঙালি অস্ত্র। সে সময় জয়দেবপুরের ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ীতে অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টে ২৫-৩০ জন জওয়ান ও অফিসার ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি।
এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের সমর্থন কামনা করা হয়। বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহ করা অস্ত্রের দ্বারা বাংলাদেশ ওপর গণহত্যা চালানের প্রয়াস বন্ধ করারও আবেদন জানানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই বিমান চলাচল বন্ধের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান সংগ্রাম পরিষদ নেতারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে অসংখ্য তারবার্তা পাঠায়। তারবার্তায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের গণহত্যা চক্রান্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে গণহত্যা থেকে তাদের নিবৃত্ত করার জন্য তাদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়।
এছাড়া এদিন চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনার সরজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি দলীয় তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামে যায়। ঢাকায় বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।
বাংলার বিবেক /এম এস
Leave a Reply