অনলাইন ডেস্ক: দেশসেরা রাজশাহী কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন সাবরিনা সবনম হিমু। সরকারি চাকরির জন্য হিমু কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছেন। নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ঘুরেছেন। কিন্তু চাকরি হয়নি। হিমু রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য। চাকরি না পেয়ে পেট চালাতে হাটে-বাজারে টাকা তুলতে হয় তাকে। হিমু বলছেন, চাকরি পেলে তিনি পুরনো এ পেশায় থাকতেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম নেয়া হিমু এখন থাকেন রাজশাহীতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হওয়ায় রাজশাহী মহানগরীতে প্রায় শতাধিক হিজড়া হাটে-বাজারে টাকা তুলে পেট চালান। এ শহরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪৫০ জন। নানা লাঞ্ছনা সহ্য করে বেশিরভাগই পরিবারের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু যারা পরিবারে থাকতে পারেন না তারা নামেন রাস্তায়।
হিমুর মতো তাদের টাকা তুলে দিন চালাতে হয়। কোন বাড়িতে নবজাতকের জন্ম হলে দলবেঁধে তারা গিয়ে নেচে-গেয়ে টাকা নিয়ে আসেন। পেটের দায়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েন যৌন পেশায়। এতে তারা এইচআইভিসহ নানা রকম যৌন রোগের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।
হিমু জানান, ২০০৭ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর জনতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ২০০৯ সালে রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন। এরপর ২০১৯ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর চাকরির জন্য অনেক ছোটাছুটি করেন। হিমু বলেন, ‘রেলে-প্রাইমারিতে পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু চাকরি হয়নি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজড়া বলে নেয়নি। আমার তো ব্যাকিং নাই যে কেউ চাকরি দিবে।’
রাজশাহীর হিজড়া জনগোষ্ঠীর আক্তারুজ্জামান মাহি পড়াশোনা করেছেন ডিগ্রি প্রথম বর্ষ পর্যন্ত। কিন্তু তারপর আর পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারছিলেন না। চেষ্টা করেও পার্টটাইম কোন চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তাকেও আদি পেশায় নামতে হয়। মাহি বলেন, ‘পড়াশোনা করেও তো চাকরি পাইনি। এখন ভোর হলেই তিনজন মিলে কালেকশনে নামি। এই কাজ আর ভাল লাগে না। মানুষ তো ভালবেসে পয়সা দেয় না। চাকরি পেলে এই পেশায় থাকতাম না।’
রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছেন মিস ডালিয়া। তারপর তাকেও নামতে হয়েছে হাটে-বাজারে। ডালিয়া বলছেন, ‘যদি কোন কৌটা থাকত তাহলে হয়তো চাকরি হতো। কিন্তু এই পরিচয় নিয়ে কোথাও চাকরির সুযোগ পাইনি। বাধ্য হয়ে আমাকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই চলে আসতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে থাকি। টাকা তুলি। এভাবেই চলছে। এই জীবন খুব কষ্টের। আমরা কাজ চাই। কালেকশনের পথ ছাড়তে চাই।’
রাজশাহীর হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য মিস পলি খাতুন বুটিকসের ব্যবসায় সফলতা পেয়েছেন। তিনি হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজ শিখিয়ে সমাজের মূল স্রোতধারায় আনার চেষ্টা করছে। পলি বলেন, ‘হিজড়ারা পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠী। আমার ক্ষেত্রেই যদি বলি তাহলে বাবা-মা বলেছিল, পড়াশোনা শিখিয়ে কি হবে! চাকরি তো পাবে না। এই মনোভাবটা সবার আগে দূর করতে হবে। সরকারের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত যেন বাবা-মা ভাবতে পারেন তার সন্তান হিজড়া হলেও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাবে।’
রাজশাহীতে হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মিস মোহনা বলেন, ‘কর্মসংস্থান না থাকার কারণে হিজড়ারা পিছিয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন যে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু আমরা পিছিয়ে। রাজশাহীতে যতজন জনপ্রতিনিধি আছেন তারা যদি মনে করেন যে দুইজন করে হিজড়ার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন তাহলে শহরে একজনও চাঁদাবাজির পথে থাকবে না। জনপ্রতিনিধিদের জন্য এটা খুব কঠিন কাজ নয়।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর অনেক হিজড়া উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু একজনও চাকরি পেয়ে উদাহরণ হতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে তারা আদি পেশায় চলে যাচ্ছে। পেটের দায়ে কেউ কেউ যৌন পেশায় নামছে। যদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তোলা যায় তাহলে সুফল মিলবে। হিজড়াদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেই তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে আসতে পারবে। তাহলে আমাদের প্রতি মানুষের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেটার পরিবর্তন হবে।’
জানতে চাইলে শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান বলেন, ‘জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উদ্যোগে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে হিজড়াদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছি। তারা রূপচর্চায় বেশ আগ্রহী। সেকারণে তাদের বিউটিফিকেশন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ব্লক-বাটিকের কাজ শেখাচ্ছি। আর যারা একটু পড়াশোনা জানে তাদের কম্পিউটার শেখাচ্ছি। দু’একজন উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। কীভাবে তারা নিজেদের আদি পেশা থেকে বের হয়ে আসতে পারে আমরা তাদের সেটা বোঝাচ্ছি।’
তবে হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা কারণে তারা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে সন্তোষ্ট নন। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। কয়েকজন বলেছেন, কম্পিউটারের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায় কম সংখ্যক কম্পিউটার, কিন্তু তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি প্রশিক্ষণার্থী। তারা কিছুই বুঝতে পারেন না।
এ বিষয়ে শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান বলেন, ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরা কোন ধরনের প্রশিক্ষণ পেলে উপকৃত হবে সেটা আমরা জানার চেষ্টা করি। সেভাবেই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। আমাদের যে সমস্ত দুর্বলতা আছে সেগুলো কাটানোর চেষ্টা করছি। কারণ আমরা মনে করি যে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই বাধ্য হয়ে তাদের আদি পেশায় নামতে হয়। তাদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’ সোনালী সংবাদ।
বাংলার বিবেক ডট কম – ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
Leave a Reply