অনলাইন ডেস্ক : খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে কৃষিঋণ বিতরণ বাড়ানো হয়েছিল। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত-বেসরকারি ব্যাংক নির্বিশেষে সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে কৃষিঋণ বিতরণে বাধ্য করা হয়েছিল। যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে শাখা নেই প্রয়োজনে বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে ঋণ বিতরণে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য সুদ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষকের কাছে টাকা পৌঁছানোর শর্তে বেশি সুদের কৃষিঋণ প্রচলন করা হয়েছিল এবং ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরে বাড়তি সুদের কৃষিঋণ কমানো তো সম্ভব হয়নি বরং আরও বেড়ে গেছে। ফলে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ সুদ হারে ঋণ নিতে হচ্ছে গ্রামের পল্লী গরিব কৃষককে। কৃষক সর্বনিম্ন সুদ হারে ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
২০১০ সাল থেকে এ হার নামিয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যান্য ঋণের সুদ হার ১২ থেকে ব্যাংক ও ঋণের ধরন ভেদে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। এ হার ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কার্যকর ছিল। আর আগে থেকে কৃষি ঋণের সুদ হার কম হওয়ার কারণে আগের হার বহাল রাখা হয়েছে।
২০১০ সালে কৃষিঋণ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিকে চাঙ্গা করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বেসরকারি নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ নির্দেশনা জারি করে।
যে সব ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই সে সব ব্যাংককে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরআই) নিবন্ধিত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণে অনুমতি দেওয়া হয় এবং সুদ হার বেঁধে দেওয়া হয় ২২ থেকে ২৭ শতাংশ। এমএফআইগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কৃষকের মাঝে বিতরণ করবে এবং অপারেটিং চার্জ রেখে তারা এ ঋণ বিতরণ করবে। শুরুতে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল মোট কৃষি ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ক্রমান্বয়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব চ্যানেলে কৃষিঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু সময় গড়িয়েছে সেই সঙ্গে মোট কৃষি ঋণ বেড়েছে, বেড়েছে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ। আর কৃষকের ঘাড়ে ব্যাংকের ঋণের বাড়তি সুদ হার যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করবে ১১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করবে ১৫ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বিতরণ করা হয়েছে ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা ও বড় বড় কৃষি ফার্মের মাধ্যমে। ২০১০ সালে এ হার ছিল এক-তৃতীয়াংশের সামান্য ওপরে।
ব্যাংকগুলোর নিজস্ব চ্যানেলে বিতরণ করা কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি ফোনে খোলা কাগজকে বলেন, যে সব ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে শাখা নেই তারা ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করত। এর মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সরাসরি টাকা পৌঁছে যাচ্ছে। একটু সুদ হার বেশি হলেও তারা ঋণ পাচ্ছেন। এর ফলে মহাজনি ঋণের চেয়ে ভালো হচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মূল শাখার পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা খুলছে। এ সব উপশাখা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। যে ব্যাংক এনজিও বা ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করছে তাদের এই সব উপশাখা বা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে কমে আসবে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার।
কৃষিঋণ বিতরণে বেশি সুদের ঋণ কমিয়ে আনার পথে প্রধান বাধা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনিহাÑ এমন তথ্য মিলেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের। কমপক্ষে চারটি বেসরকারি ব্যাংকের এ ধরনের শাখা প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে। কোনো কোনো ব্যাংক থেকে জানিয়েছে, কৃষিঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিলেই ঊর্ধ্বতন মহল (বোর্ড পর্যায় থেকে) থেকে বাধা আসে।
এ ছাড়া কৃষি এ ঋণ বিতরণ করতে গেলে অপারেটিং চার্জ বেশি পড়ে, সময় মতো ফেরত আসে না এবং বেশি মনোযোগ দিতে হয়। বোর্ড থেকে মুনাফা ও নিজেদের হিসাব-নিকাশের বিষয়টি বেশি মনোযোগ দেয়। এর ফলে চাপা পড়ে যায় নিজস্ব চ্যানেলে তুলনামূলক কম সুদে কৃষিঋণ বিতরণের নির্দেশনা। আর কৃষিঋণ বিতরণ করার পরিবর্তে কোনো কোনো ব্যাংক বিশেষ সুবিধা চায়- এমন খবর দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণে এনজিও নির্ভরতা ও কৃষিঋণ বিতরণে বেপরোয়া মনোভাবের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজস্ব চ্যানেলের পরিবর্তে এনজিওর দিকে ঝুঁকছে। এ সব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার বার তাগাদা দিলেও নিজস্ব চ্যানেলে কৃষিঋণ বিতরণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলার বিবেক /এম এস
Leave a Reply