ইসলামীক ডেস্ক: নারী-পুরুষের সম্পর্কের বন্ধন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবনে একে অপরের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধনের মর্যাদাও অনেক বেশি। এ বন্ধনের প্রথম পরিচয় হলো- আমরা কারও সন্তান, কারও জীবনসঙ্গী বা কেউ আমাদেরই সন্তান। প্রতিটি পরিচয়ই মানুষকে কোনো না কোনো বন্ধনে আবদ্ধ করে। সম্পর্কে এ বন্ধনই মানুষের পরিচয়। বন্ধনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো- নারী ও পুরুষ। এর মধ্যে নারীর ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়।
দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষের এ বন্ধন ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে রয়েছে কুরআনুল কারিমের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। যেসব দিকনির্দেশনা পারিবারি ও সামাজিক জীবনকে পরস্পরকে দায়িত্বশীল হতে শেখায়।কুরআনুল কারিমের এসব নির্দেশনা কতইনা সুন্দর!
সুখী দাম্পত্য জীবন প্রসঙ্গে
বিবাহিত জীবনে নারী পুরুষের সুখময় জীবনের কথা তুলে ধরে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
– وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ إِذَا أَنتُم بَشَرٌ تَنتَشِرُونَ
তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি মৃত্তিকা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ, পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছ।’ (সুরা রূম : আয়াত ২০)
– وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ (সুরা রূম : আয়াত ২১)
আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে নারী-পুরুষের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টির কথা বলেছেন। কারণ বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি মুগ্ধ থাকে। সে সময় ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়। সময়ের প্ররিক্রমায় একে অপরের এ টান কমে গেলেও দাম্পত্য জীবন ও সন্তান-সন্তুতি এ সম্পর্ককে মধুর ও সুখময় করে তোলে।
সব কিছুর উপর পরিবার
নারী-পুরুষের এ সম্পর্কের মধ্যে সবার আগে পরিবার বন্ধন খুবই জরুরি। একে অপরের প্রতি দায়িত্ব পালনে মর্যাদা আন্তরিকতা ও সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ মর্মে আয়াত নাজিল হয়-
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ – وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ – فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ – وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ
(হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের পরিবারবর্গদের সতর্ক করে দিন। আর আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হোন। যদি তারা আপনার অবাধ্যতা করে, তবে বলে দিন, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত। আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী, পরম দয়ালুর (আল্লাহর) উপর।'(সুরা শোয়ারা : আয়াত ২১৪-২১৭)
নিজ নিজ স্ত্রীদের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম কথা বলার প্রতি নির্দেশনার পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। যাতে সবাই পারিবারিক ও ধর্মীয় জীবনে সুখী ও আনুগত্যশীল হতে পারে।
বিয়ে-শাদীতে অধিকার
নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া ঠিক নয়। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখে নেবে। পারস্পরিক পছন্দ ও সম্মতিতে বিয়ের ব্যবস্থা বা বন্ধন পাকাপোক্ত করাই উত্তম। এতে আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। অন্যথায় সম্পর্কে ফাটল ধরার সম্ভাবনা থাকে। তাইতো মহান আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যপারে তাকে ভয় করতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
– وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর (স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে) আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১)
কেননা আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারে তাকে ভয় করার নির্দেশ দিয়ে বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيراً وَنِسَاء
হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১)
বিয়ের মাধ্যমে নারীরাও পুরুষদের কাছ থেকে অধিকার লাভ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنكُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا
তোমরা কিরূপে তা গ্রহণ করতে পার, অথচ তোমাদের একজন অন্য জনের কাছে গমন কর। এবং নারীরা তোমাদের কাছে থেকে এক সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।’ ( সুরা নিসা : আয়াত ২১)
নারী-পুরুষের বিয়ে একটি পবিত্র ও নিবিড় সম্পর্ক। পুরুষরা ভেবে থাকে, বিয়ের মাধ্যমে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যায়। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র পছন্দে মেয়েদেরও রয়েছে অধিকার। হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে-
হজরত খুনাসা রাদিয়াল্লাহু আনহা নামে এক (সাহাবি) নারীকে তার বাবা বিয়ে দেন। এই বিয়ে তার পছন্দ ছিল না। এরপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলে প্রিয়নবি এ বিয়ে বাতিল করে দেন।’ (বুখারি)
চাপ প্রয়োগে গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা
অনেক সময় নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী কিংবা শ্বশুর বাড়িরর চাপে নারীর গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। এ গর্ভপাত হত্যার শামিল। অথচ এ বিষয়ে অন্যায়ভাবে গর্ভপাতরোধে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيرًا
দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ।’ (সুরা বনি-ইসরাঈল : আয়াত ৩১)
আল্লাহ তাআলা নারীর গর্ভধারণের মাধ্যমে বনি আদমকে দান করেছেন শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও সম্মান। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلاً
নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি-ইসরাঈল : আয়াত ৭০)
সন্তানের কাছে মর্যাদা
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা সন্তানদের কাছে নারী-পুরুষ উভয়কে মর্যাদা দিয়েছেন। এখানে পুরুষকে নারীর উপর মর্যাদা দেয়া হয়নি। বরং হাদিসে নারীর (মায়ের) অধিকার পুরুষের (বাবার) তুলনায় তিনগুণ বেশি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহা র কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদের সঙ্গে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।’ (সুরা বনি-ইসরাঈল : আয়াত ২৩)
তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও দোয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
তাদের সামনে ভালবাসার সঙ্গে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। ‘ (সুরা বনি-ইসরাঈল : আয়াত ২৪)
ইসলাম নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা ও অধিকার। আর তা বাস্তবায়ন করে নারীকে তার অধিকারগুলো বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে পুরুষে। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত নারীকে তাদের মর্যাদা ও যথাযথ অধিকার দেয়া। কুরআন-হাদিসের ওপর আমল করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত ও অবহেলিত নারী অধিকার নিরাপত্তা মর্যাদা নিশ্চিত করতে কুরআনের দিকনির্দশনাগুলো তুলে ধরার তাওফিক দান করুন। নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলার বিবেক / এফ কে
Leave a Reply